সভ্যতা-১

খলীফা মামুনের রাজত্ব
মূল : সৈয়দ আব্দুস সবুর তারিক
অনুবাদ : জি.এম. আশেক রহিম

     খলীফা হারুনুর রশিদের ছেলে। আল্লামা মামুনুর রশিদ। রাজত্বকাল ৮১৩-৮৩৩ খ্রীঃ। জ্ঞান গরিমা-দয়াশীলতা-উন্নত চরিত্র-কীর্তি-বীরত্ব-অদম্য উদ্যম হিম্মৎবান ব্যক্তি ছিলেন। খেলাফতে আব্বাসিয়ার অনেক বড় সাশক ছিলেন। তাঁর ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন সবাই একমত যে, বনু-আব্বাস খলীফাগণের মধ্যে প্রজ্ঞা-দৃঢ় সংকল্প-সহনশীলতা-বুদ্ধিমত্তা-বিচার বিবেচনা-ভাব গাম্ভীর্য-বীরত্ব-অদম্য সাহস ও দানশীলতায় তাঁর চেয়ে উত্তম আর কেউ ছিলেন না। ‘আল-মামুন’ ইতিহাস গ্রন্থে মাওলানা শিবলী নু‘মানী লিখেন, সকল খলীফা ও সুলতানগণের তালিকায় (চার খলীফা, ওমর ইবন আব্দুল আযীয-এর মত দু‘চারজন ছাড়া) পূর্ণাঙ্গতার দিক থেকে তিনি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সাহিত্য-হাদীস-ফিক্হ-আরব ইতিহাস-কবিত্ব-খান্দান-দর্শন-কৌশল-গণিত-জ্যোতিষ বিদ্যা, যে বিষয়ের আসরেই যাওয়া হয় না কেন তাকেই প্রধান মনে হয়। বীরত্বপূর্ণ বিজয়ের কারণে দুনিয়ার সভ্যতার ইতিহাসে তিনি খ্যাতিমান ও স্মরণীয় ব্যক্তি হিসাবে রয়েছেন। বীরত্বের লড়াই-এ তাঁর তেজদীপ্ত হাত দেখে বিশ্বাস করা যেত না যে, ওই হাতে তিনি তরবারী ছাড়া কখনো কলম স্পর্শও করেছেন।
     ব্যক্তি সত্ত্বার দিক দিয়ে তিনি এমন পবিত্র ও পূন্যবান ছিলেন যে, বাদশাহ দূরে থাক ফকীর-দরবেশগণের মধ্যে এমন দু‘চার জন খুঁজে পাওয়া ভার। বিনয়-সহিষ্ণুতা-ক্ষমাশীলতা-দানশীলতা-দিল দরিয়া-অদম্য হিম্মৎ-বাহাদুরীসহ কোন গুণ বাদ নেই আল্লাহ তাঁর থেকে দূরে রেখেছেন।
     এত সব গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো একনায়কতন্ত্র শান-শওকতের মধ্যে তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন; যা ভাবলে অন্তর কেঁপে উঠে। হঠাৎ তাঁর ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গিয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ রূপ ধারণ করতো। তথাপি সব দিক বিবেচনায় ইসলামী মুক্তাসমূহের মধ্যে তিনি এক চমকদার হিরা ছিলেন।
     ইতিহাসবিদ শিবলী বলেন, খলীফা মামুন এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য যে, তিনি উচ্চ পর্যায়ের দার্শনিক ও সাধক হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় বিশ্বাসে চূড়ান্ত ও ইস্পাত কঠিন বিশ্বাসী ছিলেন। ফরয-ওয়াজিব-সুন্নতসহ অন্যান্য ইবাদতসমূহ নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তাঁর ইশক-মুহাব্বত চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল।
     অন্য এক ইতিহাসবিদ খলীফা মামুনের ব্যাপারে তাঁর মত এভাবে ব্যক্ত করেন যে, জন সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে হারুনুর রশিদের খিলাফত কাল জাতির জন্য যেমন উপকারী মামুনের সাশনামলও তেমনি। মামুন প্রজাদের সুখের জন্য শান্তির প্রতীক ছিলেন। জ্ঞান ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিক্ষা এবং প্রচার-প্রসারের জন্য পানির মত স্বর্ণ বিলিয়েছেন। প্রজাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ব্যাপক নিরাপত্তা ও সাধারণ সুযোগ-সুবিধার জন্য তিনি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন এর উদাহরণ খুলাফায়ে রাশেদাহ ও ওমর ইবন আব্দুল আযীযের সাশনামল ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না। অথচ তাঁর রাজসভায় ইয়াহইয়া বরমকী, ফযল, জা‘ফর, কাজী আবু ইউসুফ, কাজী মুহাম্মাদ, হাফিয ও আবু নাওয়াসের মত কোন উপদেষ্টা ছিলেন না। তিনি নিজ জ্ঞান-কীর্তি-প্রজ্ঞা-বুদ্ধিমত্তার বিবেচনায় কোনো ইমাম বা বড় আলেমের চেয়ে কম ছিলেন না।
     তিনি একাধারে একজন বড় মুহাদ্দিস, মুফতী ও একনিষ্ঠ মুসলিম সম্রাট ছিলেন। উত্তম ও উচ্চ পর্যায়ের কবি ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন। অসংখ্য হাদীস তাঁর মুখস্ত ছিল। তিনি কুরআনের হাফিয ছিলেন। ইসলামের রীতিসমূহ বড় নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন।
     বাদশাহদের মধ্যে অনেকেই আলেম ছিলেন; কিন্তু মামুনের মত কেউ না। পণ্ডিত আকবর শাহ খান নজীবাবাদী বলেন, কুরআন তিলাওয়াতে তার বড় আগ্রহ ছিল। কোন কোন রমযানে তিনি প্রতিদিন এক খতম কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন।
     বিচারকের স্পষ্টবাদিতাঃ মামুনুর রশিদ বড় ন্যায়পরায়ণ বাদশা ছিলেন। তাঁর বিচার-প্রাসাদে উঁচু-নিচু সবাই বরাবর। ইতিহাসবিদ বলেন, তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়-অত্যাচার নির্মূলে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। রবিবার সকাল থেকে যোহর পর্যন্ত প্রজাদের অভিযোগ শুনতে তিনি নিজেই বসতেন। তাঁর প্রধান বিচারপতিও খুব ন্যায়পরায়ণ ও সাহসী ছিলেন। স্বয়ং মামুনুর রশিদ আদালতে হাজির হলে তাঁর সাথেও ভিন্ন আচরণ করতেন না। একবার আদালতে খাদেমগণ খলীফার জন্য আলাদা সম্মানের ব্যবস্থা করতে চাইলে বিচারপতি নিষেধ করে দিলেন; সুযোগ দেয়া তো দূরের কথা। খলীফা তাঁর (ন্যায়পরায়ণতায় মুদ্ধ হয়ে) বেতন বৃদ্ধি করে দিলেন।
     এই বিষয়ে মুঈনুদ্দীন নদভী লিখেন, একবার এক ব্যক্তি খলীফার উপর ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দাবী করলেন। প্রধান বিচারপতি খলীফাকে আদালতে তলব করলেন। খলীফা আদালতে হাজির হলে সেবকগণ তাঁর জন্য গালিচা বিছিয়ে দিলেন। প্রধান বিচারপতি এতে নিষেধ করে দিলেন। বললেন, আদালতে বাদী-বিবাদী উভয়েই সমান। কারো জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে না। মামুনুর রশিদ বিচারপতির সততার উপর খুশি হয়ে তার বেতন বৃদ্ধি করে দিলেন।
     কলম ও তলোয়ারঃ খলীফা মামুনুর রশিদ শুধু একজন বিদ্যান আর সাহিত্যিকই ছিলেন না। তিনি একজন বীর-বাহাদুর যোদ্ধাও ছিলেন। এর প্রমাণ ওই সব অভিযানে পাওয়া যায়; যেসব অভিযান তিনি রোম দেশে পরিচালনা করেছেন। এসব এলাকা জড়সধহ ঊসঢ়রৎব এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেসব অভিযানে তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। এই কারণেই সে অভিযানগুলো চিত্তাকর্ষক ছিল। সত্য কথা হলো, যদি সেসব অভিযানে তাঁর বীরত্ব ও বাহাদুরীর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নৈপুণ্য না থাকতো তবে ইতিহাসবিদদের কলমে তিনি শুধু একজন কবি ও সাহিত্যিক হিসাবে উপাধী পেতেন।
-চলবে ইনশা-আল্লাহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন