জীবনী-২


ফজলুর রহমান
বেগম রেহেনা রহমান

     এ.কে.এম. ফজলুর রহমান। তিনি ১৯৫০ -এর দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল পরগনার টিঘর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যু ২০০৫ সালের ২৩ নভেম্বর। তিনি আমরণ সত্যের তরে তপস্যা করে গেছেন; অসত্যকে দু‘পায়ে দলেছেন প্রতিনিয়ত। আল্লাহর উপর ছিল তাঁর পূর্ণ আস্থা-ভরসা। এই জগতের স্বর্গ-সুখের আশ্বাস পেয়েছেন বহুবার; কিন্তু বরাবরই তিনি বিরত্বের সাথে মোকাবিলা করেছেন শয়তানী কুমন্ত্রণার। সুদ-ঘুসের মোকাবিলায় আজীবন যুদ্ধ করেছেন তিনি।
     তাঁর সুন্দর সদালাপী-সদাচারী-হাস্যময় ব্যবহারে মুগ্ধ ছিল সবাই। আজও পর্যন্ত তাঁর পরিচিতজনেরা এ কথাই বলে “এমন একজন মানুষ হয় না। ... তিনি আমাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।” ইত্যাদি। এ সবই হলো, তাঁর সততা-সরলতা-সত্যবাদিতার জন্য। তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন আল্লাহর জন্য; কারো হক (অধিকার) নষ্ট করতেন না। তাঁকেও  মানুষ অনেক ভালোবাসতেন। আমানতদারীতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। যে কোন জিনিস তাঁর কাছে যেভাবে আমানত দেয়া হতো সেভাবেই তিনি ফেরত দিতেন; খিয়ানতের প্রশ্নই উঠত না।
     তিনি সন্তানদের যথা সাধ্য ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে বড় আলেম বানাতে চেষ্টা করে গেছেন আজীবন। সকলকেই পড়িয়েছেন মাদরাসায়। সন্তানদের মাদরাসায় দিয়েই ক্ষ্যান্ত হন নি তিনি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর নিয়মিত বিভিন্ন তাসবীহ-তাহলীল আদায় করে, খতমে খাজেগান-খতমে হাবিবী ইত্যাদি আদায় করে অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে দু‘আ করতেন মাওলা কারীমের দরবারে।
     তিনি মৃত্যুর এগার মাস পূর্বে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি আর এগার মাস পরে বুধবারে মারা যাব।” দিন যতই ঘনাচ্ছে তিনি ততই হিসাব করে করে বলে যাচ্ছেন। আমরা ভাবতাম তিনি এমনি এমনি বলেন; কৌতুক করেন। কিন্তু না, এক মাস আগে তিনি দুঃখ নিয়ে বললেন, “এক মাস পরে আমি বুধবারে ভোর রাতে মারা যাব। জানি না আমার সন্তানদের ভাগ্যে কি আছে।” তখন আমাদের কিছুটা বিশ্বাস হয়েছিল। মৃত্যুর এক সপ্তাহ পূর্বে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রাহ্মণবাড়ীয় মেডিকেলে ভর্তি করা হল। পরিশেষে ডাক্তার বললেন, রোগীকে ঢাকা নিতে হবে। পরিবারের লোকজন ঢাকা নেয়ার ব্যবস্থা করতে চাইলে তিনি বললেন, “যদি আমাকে ঢাকা নাও, ঢাকা যাব আর লাশ হয়ে ফিরে আসব।” তাঁর কথায় গুরুত্ব দিয়ে তাঁকে নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।
     চিকিৎসা বিধান মতে ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, প্রতি রাতে একটা করে ইনজেকশন করতে হবে, একটা ট্যাবলেট খেতে হবে। তিনি মঙ্গলবার দুপুরে বললেন, “আজ দুটো ইনজেকশন আনতে হবে আর একটি ট্যাবলেট।” আমরা খুশি হলাম; ভাবলাম দু‘টি ইনজেকশন মানে আজ (মঙ্গলবার) রাতে একটি আর বুধবার রাতে একটি। অতএব, ‘তিনি বুধবারে মারা যাবেন!’ এ কথা থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এ কি! মঙ্গলবার রাতে ইনজেকশন পুশ করার সময় পুশকারীর অসর্তকতায় হাত ফসকে পুরো ঔষধ পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরে অপর ইনজেকশনটি পুশ করা হয়! এই দু‘টি ইনজেকশন তাঁর পূর্ণ হল আর ট্যাবলেট খেলেন একটি।
     বুধবার ভোর রাত। প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। পাশে বসে আছেন তাঁর স্ত্রী-কন্যারা। হঠাৎ তিনি আসমানের দিকে তাকিয়ে কি যেন পড়লেন; বললেন, “আল্লাহ! আল্লাহ! আল্লাহ!” তিন বার “আল্লাহ” শব্দটি উচ্চারণ করেই রাব্বে আলার সাথে মিলিত হলেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিঊন।
     তিনি মৃত্যুর আগে সরাইল থেকে ফেরার সময় মাঝেমধ্যেই গ্রামের কবরস্তানের একটি জাগায় বসতেন কখনও কখনও শুইতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “এখানে আমার ভালো লাগে।” যখন তিনি আল্লাহর দরবারে চলে গেলেন, তখন পরিবারের সবাই ব্যস্ত আত্মীয় স্বজনকে খবর দিতে, গোসল-কাফনের ব্যবস্থা করতে। যারা কবর খনন করতে গেছেন তাদের সাথে যোগাযোগেরও ফুরসত নেই। তাঁর পরিবারের লোকজন কবরে গেছেন জানাযার পর লাশ দাফন করার সময়। সুবহানাল্লাহ! গিয়ে দেখেন, তিনি কবরস্তানের যেখানে মাঝেমধ্যে বসতেন বা শুইতেন সেখানে প্রস্তুত তার কবর! তাঁর ‘ভালোলাগা’র সেই জায়গাতেই সমাহিত করা হয় তাঁর দেহ। আল্লাহ তাঁর ‘ভালোলাগা’ কবরকে বেহেশতের টুকরো হিসাবে কবুল করুন। আমীন! ছুম্মা আমীন!!
     তিনি জীবনভর যে নীতিতে অটল ছিলেন তা হল, “মুখ বন্ধ শত্র“ নাই। সোজা পথে চল, শয়তানের কান মল।” তিনি বলতেন, “কারো কাঁচা লাইলে (জমির পাড় বুঝাতে ‘লাইল-আইল-হাইল’ বলা হয়। প্রতিটি শব্দই শুদ্ধ। এসেছে আরবী হতে। অর্থ হল, ‘প্রাচীর-দেয়াল’।) পা দিও না।” নিজে মাঝেমধ্যে বলতেন, “ডাল দিয়ে ভাত খাব, পাঁচ আঙ্গুলে নলা (শব্দটি ফারসী নাওয়ালা এর কোমল রূপ।) ধরব। সোজা পথে হাঁটব, বিরালকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাব।”
     তাঁর কথার সার মর্ম হল, প্রয়োজনে কষ্ট করে জীবন-যাপন করবো। হালাল খাবার আহার করবো। বিলাস প্রিয় হবো না; আর বিলাসিতার জন্য হারাম পথে পা ফেলবো না। মানুষ সাধারণত আরাম-আয়েশ, আহার-বিহারের জন্যই নিজের শ্রম উৎসর্গ করে। অসৎ মানুষ নিজের আয়েশী জিন্দেগীর জন্য হালাল-হারামের চিন্তা করে না। অপরের হক যথেচ্ছ নষ্ট করে। আত্মসাৎ-জবরদখল করে। সোজা পথে হাঁটলে, কারো কোনো কথায় অযথা কান না দিলে কোন অপরাধ সংঘটিত হতে পারবে না; তাই কোন সালিস-মাতবরের ধার ধারতে হবে না। সারা জীবন পরিবার-পরিজনদের সবরের সবক শিখিয়ে গেছেন। চিনিয়ে গেছেন সততা ও ন্যায়ের পথ। আল্লাহ পাক তাঁকেসহ আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমীন!
হে খোদা আমায় সোজা পথ দেখাও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন